,

উত্তাল ক্যাম্পাস, চার তদন্ত কমিটি, অভিযোগের পাহাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক: নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনায় উত্তাল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। গতকাল মঙ্গলবার দিনভর বিক্ষোভ করেছে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। ঘটনা তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও স্কুল কর্তৃপক্ষ পৃথকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ ছাড়া অল্প বয়সী একটি মেয়ে কেন এজাতীয় চরম অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত নেবে তার কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কমিটিকে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধের উপায় নির্ণয় করে একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতেও বলা হয়েছে।

অতিরিক্ত শিক্ষা সচিবের নেতৃত্বে এ কমিটিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিবের নিচে নয় এমন একজন প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, মনোবিদ ও আইনবিদকে রাখতে বলা হয়েছে। বিক্ষোভের সময় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গেলে তাঁকেও প্রায় ১৫ মিনিট অবরোধ করে রাখে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। মন্ত্রী পরে সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনিও স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের কথা শুনেছেন, এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এদিকে ঘটনার জন্য ভিকারুননিসা নূন স্কুলের প্রভাতী শাখার প্রধান জিন্নাত আরাকে কারণ দর্শাও (শোকজ) নোটিশ দেওয়ার পাশাপাশি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাঁর কাজ থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এদিকে অধ্যক্ষসহ তিন শিক্ষকের বিরুদ্ধে আত্মহননে প্ররোচনার অভিযোগে মামলা করেছে বাবা দিলীপ অধিকারী। গতকাল রাতে পল্টন থানায় এ মামলাটি (নম্বর ১০) করা হয়েছে। পল্টন থানার ডিউটি অফিসার এসআই সুজন তালুকদার বলেন, সন্ধ্যার পরে দিলীপ অধিকারী থানায় এসে মামলা করেন। এতে কলেজের অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস, প্রভাতী শাখার প্রধান জিন্নাত আরা ও শ্রেণি শিক্ষক হাসনা হেনাকে আসামি করা হয়েছে। রবিবার পরীক্ষার হলে অরিত্রীর কাছে মোবাইল ফোন পাওয়া গেলে তাকে চলমান পরীক্ষা থেকে বহিষ্কার করা হয়। সোমবার তার মা ও বাবাকে স্কুলে তলব করে জানিয়ে দেওয়া হয় অরিত্রীকে স্কুল থেকেও বহিষ্কার করা হবে। তখনই অরিত্রী বাসায় চলে যায়। বাসায় ফিরে মা-বাবা দেখেন অরিত্রীর নিথর দেহ ঝুলছে।

ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল সকাল থেকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বেইলি রোড প্রধান ক্যাম্পাসের সামনে বিক্ষোভ শুরু করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তারা অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিন্নাত আরাকে বরখাস্তের পাশাপাশি গভর্নিং বডি ভেঙে দেওয়ার দাবি তুলেছে। আজ সকালেও তারা একই দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে।

বিক্ষোভ চলাকালে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে শিক্ষামন্ত্রী স্কুল পরিদর্শনে যান। তিনি মেয়েটির শ্রেণিকক্ষ ও পরীক্ষার হল পরিদর্শন শেষে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। পরে সাংবাদিকদের মন্ত্রী বলেন, ‘কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো শিক্ষক মানসিক বা শারীরিকভাবে কোনো শিক্ষার্থীকে নির্যাতন করতে পারেন না। এটি অপরাধ হিসেবে গণ্য। আমি ছাত্রী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের নানা ক্ষোভের কথা শুনেছি। তদন্ত কমিটি সব বিষয় বিবেচনায় নেবে আশা করি। এর পরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

স্কুল গেটের সামনে দিলারা চৌধুরী নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে আমরা এই ঘটনার বিচার চাই। স্কুলের শিক্ষক হলেও তাঁর জবাবদিহি থাকতে হবে। তিনি তো সব কিছুর ঊর্ধ্বে নন।’ নাম প্রকাশ না করে আরেকজন অভিভাবক বলেন, ‘ভিকারুননিসা নূন স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষকই পুলিশের মতো আচরণ করেন। বাচ্চাদের গালি দেন। মানসিকভাবে নানা অত্যাচার করেন। এই স্কুলের প্রতিটি বাচ্চাকেই মানসিক রোগী বানিয়ে ফেলেছেন তাঁরা। আমরা এই অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।’

অভিভাবকরা অভিযোগ করেন, প্রতিষ্ঠানের সব বিষয় দেখভালের দায়িত্ব গভর্নিং বডির থাকলেও তারা শুধু ভর্তির সময় স্কুলের দিকে নজর দেয়। এর বাইরে তাদের তেমন একটা খবর থাকে না। প্রতিবছরই ভিকারুননিসা নূন স্কুলে বিপুলসংখ্যক অবৈধ ভর্তি করানো হয় উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, এর মূল হোতা গভর্নিং বডি। প্রতিটি শিক্ষার্থী ভর্তিতে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে। ভর্তির বাইরে তাঁরা শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের কথার কোনো মূল্য দেন না।

গত রাতে অনুপ গুহ ঠাকুর নামের একজন অভিভাবক বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম আজকের (গতকাল) পরীক্ষা বন্ধ রাখতে। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ তা করেনি। ফলে আন্দোলন বাচ্চাদের হাতে চলে গেছে। তারা বুধবারও আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে বুধবারের পরীক্ষা বর্জনেরও ঘোষণা দিয়েছে তারা।’

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। মন্ত্রণালয়ও করেছে। তারা যে সুপারিশ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর আমাদের ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই সবাইকে বলব, যারা দোষী তাদের বিচার হবে। একই সঙ্গে ছাত্রীরা যেন যথাসময়ে পরীক্ষায় অংশ নেয়।’

অরিত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে গতকাল বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন গতকাল আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের চার আইনজীবী ব্যারিস্টার অনীক আর হক, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, অ্যাডভোকেট আইনুন্নাহার সিদ্দিকা ও জেসমিন সুলতানা। জবাবে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করতে বলেন। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের উপায় নির্ণয় করে একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে এবং সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। এর আগে সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী ব্যারিস্টার সাইয়েদুল হক সুমন বিষয়টি বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনলে আদালত ওই আইনজীবীকে একটি রিট আবেদন করার পরামর্শ দেন। এদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিন্নাত আরাসহ তিনজন শিক্ষক প্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত ও তাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার জন্য আইনি নোটিশ দিয়েছেন।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক প্রফেসর মোহাম্মদ ইউসুফের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন মাউশির ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক সাখায়েত হোসেন বিশ্বাস এবং ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসার বেনজির আহমদ। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রদান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা শিক্ষা বোর্ড বিদ্যালয় পরিদর্শক অধ্যাপক প্রীতিশ কুমারকে প্রধান করে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটি আজ বুধবারের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে।

এ ছাড়া ভিকারুননিসা নূন স্কুল কর্তৃপক্ষ গভর্নিং বডির সদস্য আতাউর রহমান, তিন্না খুরশীদ জাহান ও ফেরদৌসি বেগমকে নিয়ে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তাদের আগামী সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। গভর্নিং বডির সভাপতি গোলাম আশরাফ তালুকদার বলেন, ‘সোমবার রাতে আমরা জরুরি বৈঠক করেছি। সেখানে শাখাপ্রধান জিন্নাত আরাকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কর্মে বিরত রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁকে শোকজ করা হয়েছে। আর অধ্যক্ষের কাছে এই ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।’ অভিভাবকদের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি সুপারিশের পর আমরা যদি কোনো ব্যবস্থা না নেই তখন কথা উঠতে পারে। তার পরও বলব, আমার পদত্যাগই যদি সমাধান হয়, তাহলে তা আমি করতে প্রস্তুত আছি।’

ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘এই ঘটনায় যে-ই দোষী হোক না কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শিক্ষক হোক আর গভর্নিং বডিই হোক সবাইকে নিয়ম মেনে চলতে হবে। তদন্তের পর গভর্নিং বডি যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে তারাও ছাড় পাবে না।’

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজা স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, উচ্চ আদালত এক নির্দেশনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে পরিপত্র জারি করেছে। অথচ চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত ১৭১ জন শিক্ষার্থী শিক্ষক কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে দুজন আত্মহত্যা করেছে।

গতকাল অরিত্রীর শান্তিনগরের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, মা-বাবা দুজনেই হৃদরোগী বলে তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। অরিত্রীর রুমটি সেই রকমই আছে। টেবিলে বইখাতা ছড়ানো, বিছানার ওপর জামাকাপড়। ছোট বোন হৃদি মনি অঝোরে কাঁদছিল। একই রুমে থাকত দুই বোন। হৃদি আর ওই রুমে ঢুকতে পারছে না।

এই বিভাগের আরও খবর